পদার্থের নির্দিষ্ট ভর আছে এবং এরা স্থান দখল করে। চেয়ার, টেবিল, খাতা, কলম, বরফ, পানি, বাতাস—এই সবগুলোই এক একটি পদার্থ। সকল পদার্থই কঠিন, তরল ও গ্যাসীয়—এ তিন অবস্থাতেই থাকতে পারে। এ তিন অবস্থাতেই প্রত্যেক পদার্থের নিজস্ব কিছু ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এ বিষয়গুলো নিয়েই এ অধ্যায়ের আলোচনা।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
যে বস্তুর নির্দিষ্ট ভর আছে এবং জায়গা দখল করে তাকে পদার্থ বলে। কক্ষ তাপমাত্রায় কোনো কোনো পদার্থ কঠিন, কোনো কোনো পদার্থ তরল আবার কোনো কোনো পদার্থ গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে। যেমন–কক্ষ তাপমাত্রায় চিনি, খাদ্য লবণ, মারবেল ইত্যাদি কঠিন অবস্থায়; পানি, তেল, কেরোসিন ইত্যাদি তরল অবস্থায় এবং নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি গ্যাসীয় অবস্থায় অবস্থান করে। আবার, তাপমাত্রা পরিবর্তন করে একই পদার্থ কখনো কঠিন, কখনো তরল বা কখনো গ্যাসীয় অবস্থায় রূপান্তর করা যায়। নিচে কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় পদার্থের কিছু ধর্ম এবং বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো।
2.1.1 কঠিন পদার্থ (Solids):
কঠিন পদার্থের নির্দিষ্ট ভর, নির্দিষ্ট আকার এবং নির্দিষ্ট আয়তন থাকে। সব পদার্থের কণাগুলোর মধ্যেই এক ধরনের আকর্ষণ বল থাকে। একে আন্তঃকণা আকর্ষণ বল বলা হয়। কঠিন পদার্থের কণাগুলোর মধ্যে আন্তঃকণা আকর্ষণ বল সবচেয়ে বেশি। এ কারণে কঠিন পদার্থের কণাগুলো খুব কাছাকাছি এবং নির্দিষ্ট অবস্থানে থাকে, ফলে কঠিন পদার্থের নির্দিষ্ট আকার হয়, কঠিন পদার্থের উপর চাপ প্রয়োগ করলে এরা সংকুচিত হয় না। আবার, তাপমাত্রা বাড়ালে কঠিন পদার্থের আয়তন খুবই কম পরিমাণ বৃদ্ধি পায়৷
2.1.2 তরল পদার্থ (Liquids):
তরল পদার্থের নির্দিষ্ট ভর ও নির্দিষ্ট আয়তন আছে কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই। তরল পদার্থকে যে পাত্রে রাখা হয় তরল পদার্থ সেই পাত্রের আকার ধারণ করে। তরলের কণাগুলো কঠিন পদার্থের কণাগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি দূরত্বে থাকায় এদের মধ্যে আন্তঃকণা আকর্ষণ বল কঠিনের চেয়ে কম হয়। তরল পদার্থকে চাপ প্রয়োগ করলে এদের আয়তন হ্রাস পায় না। তবে এতে তাপ প্রয়োগ করলে তরল পদার্থের আয়তন বৃদ্ধি পায়। এই আয়তন বৃদ্ধির পরিমাণ কঠিন পদার্থের চেয়ে বেশি।
2.1.3 গ্যাসীয় বা বায়বীয় পদার্থ (Gases):
গ্যাসীয় পদার্থের নির্দিষ্ট ভর আছে কিন্তু নির্দিষ্ট আকার কিংবা নির্দিষ্ট আয়তন নেই। যেকোনো পরিমাণ গ্যাসীয় পদার্থ যেকোনো আয়তনের পাত্রে রাখলে গ্যাসীয় পদার্থ সেই পাত্রের পুরো আয়তন দখল করে। গ্যাসীয় পদার্থের কণাগুলো কঠিন ও তরলের চেয়ে অনেক বেশি দূরে দূরে অবস্থান করে বলে এদের আন্তঃকণা আকর্ষণ বল খুবই কম। গ্যাসীয় পদার্থের উপর সামান্য চাপ প্রয়োগ করলে গ্যাসীয় পদার্থের আয়তন অনেক কমে যায়। আবার, ভাগ প্রয়োগ করলে গ্যাসীয় পদার্থের আয়তন অনেক বেড়ে যায়।
সকল পদার্থই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দ্বারা গঠিত। এই কণাগুলো একে অপরকে আকর্ষণ করে যাকে আন্তঃকণা আকর্ষণ শক্তি বলা হয়। আবার কণাগুলোর গতিশক্তিও রয়েছে। আন্তঃকপা আকর্ষণ শক্তি এবং কণাগুলোর গতিশক্তি দিয়ে পদার্থের কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় অবস্থা ব্যাখ্যা করার তত্ত্বকেই কণার গতিতত্ত্ব বলা হয়। যখন কণাগুলোর ভেতরকার আকর্ষণ শক্তি বা অন্তঃকণা আকর্ষণ শক্তি খুব বেশি থাকে তখন কণাগুলো খুব কাছাকাছি অবস্থান করে এবং নিজেদের অবস্থান থেকে নড়তে পারে না। এই অবস্থা হচ্ছে কঠিন অবস্থা। কঠিন পদার্থকে তাপ দেওয়া হলে কণাগুলো তাপশক্তি গ্রহণ করে কাঁপতে থাকে। যদি আরও বেশি তাপ দেওয়া হয় তাহলে কণাগুলো এত বেশি কাঁপতে থাকে যে আন্তঃকণা আকর্ষণ শক্তি কমে যায় এবং কিছুটা গতিশক্তি প্রাপ্ত হয়। পদার্থের এই অবস্থাকে তরল অবস্থা বলে। তরলের নির্দিষ্ট আয়তন থাকলেও নির্দিষ্ট আকার থাকে না। তরল অবস্থার পদার্থকে আরো বেশি তাপ দেওয়া হলে কণাগুলো তাপশক্তি নিয়ে গতিশক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে এবং একসময় গতিশক্তি এত বেড়ে যায় যে কণাগুলো আন্তঃকণা আকর্ষণ শক্তি থেকে প্রায় মুক্ত হয়ে বিক্ষিপ্তভাবে ছুটতে থাকে। এই অবস্থাকে বলে গ্যাসীয় অবস্থা। গ্যাসীয় অবস্থায় পদার্থের আর কোনো নির্দিষ্ট আয়তন থাকে না। তাকে যে আয়তনের পাত্রে রাখা হবে কণাগুলো সেই আয়তনেই ছোটাছুটি করতে পারবে। গ্যাসীয় অবস্থায় পৌঁছানোর পর যদি আরও তাপ দেওয়া হয় তখন কণাগুলো আরও জোরে ছুটতে থাকবে অর্থাৎ পতিশক্তি আরও বেড়ে যাবে।
কোনো মাধ্যমে কঠিন, তরল ও বায়বীয় পদার্থের স্বতঃস্ফূর্ত ও সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়াকে ব্যাপন বলে। ব্যাপন প্রক্রিয়ায় কঠিন, তরল কিংবা বায়বীয় পদার্থ উচ্চ ঘনমাত্রার স্থান থেকে নিম্ন ঘনমাত্রার স্থানের দিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন: ঘরের এক কোণে কোনো একটি সুগন্ধির শিশির মুখ খুলে রাখলে কিছুক্ষণের মধ্যে সারা ঘরে সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এটি ব্যাপন প্রক্রিয়ার উদাহরণ। কোনো পদার্থ ছড়িয়ে পড়তে সময় কম লাগলে ঐ পদার্থের ব্যাপন হার বেশি এবং কোনো পদার্থ ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগলে ঐ পদার্থের ব্যাপন হার কম। নিচের পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে এ বিষয়ে আরও পরিষ্কার ধারণা নিতে পারবে।
পরীক্ষা নং: 1 একইভাবে যদি গরম পানিতে KMnO এর ব্যাপনের পরীক্ষাটি সম্পন্ন করি তবে দেখা যাবে ঠাণ্ডা পানির চেয়ে গরম পানিতে KMnO, কণাগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সমর্থ পানিকে গোলাপি বর্ণে পরিণত করছে। কারণ গরম পানি থেকে KMnO4 কণাগুলো তাপ গ্রহণ করে অধিক গতিশক্তি প্রাপ্ত হয় এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ ভাগ প্রয়োগ করলে কঠিন পদার্থের ব্যাপন হার বৃদ্ধি পায় । |
পরীক্ষা নং: 2 কক্ষ তাপমাত্রার একটি বিকারে কিছু পরিমাপ বিশুদ্ধ পানি নিয়ে এতে সামান্য পরিমাণ তরল নীলের প্রবণ যোগ করো। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখবে বিকারের সমস্ত পানির রং নীল হয়ে গেছে। অর্থাৎ নীলের প্রবলের কণাগুলো সমস্ত পানিতে ছড়িয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে পানিতে তরল পদার্থ (নীলের দ্রবণ) ব্যাপিত হয়েছে। কক্ষ তাপমাত্রায় কঠিন KMnO এর ব্যাপনের চেয়ে তরল নীলের দ্রবণের ব্যাপনের সময় অনেক কম লেগেছে। অর্থাৎ তরল মাধ্যমে কঠিন পদার্থের ব্যাপন হার- এর চেয়ে তরল মাধ্যমে তরল পদার্থের ব্যাপন হার বেশি। তাপের প্রভাবে এই ব্যাপন হার আরও বেশি হয়। কক্ষ তাপমাত্রায় বা গরম অবস্থায় তরুণ মাধ্যমে গ্যাসীয় পদার্থের ব্যাপন হার সবচেয়ে বেশি হয়। |
পরীক্ষা নং: 3 দুটি গ্যাসের ব্যাপন কিছুক্ষণের মধ্যে দেখতে পাবে কাচনলের ভিতরে হাইড্রোজেন ক্লোরাইড গ্যাস ও অ্যামোনিয়া গ্যাস পরস্পরের সাথে বিক্রিয়া করে অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইডের (NH, CI) সাদা ধোঁয়ার সৃষ্টি করেছে। সাদা ধোঁয়ার অবস্থান কাচনলের ঠিক মাঝামাঝি হবে না। এটি হাইড্রোক্লোরিক এসিড দ্রবণের কাছে এবং অ্যামোনিয়াম হাইড্রোক্সাইড দ্রবণ থেকে দূরে অবস্থান করবে। অর্থাৎ একই সময়ে হাইড্রোজেন ক্লোরাইড গ্যাস কম দূরত্ব এবং অ্যামোনিয়া গ্যাস বেশি দূরত্ব অতিক্রম করেছে। এ পরীক্ষা থেকে বোঝা যায় যে, অ্যামোনিয়া গ্যাস হাইড্রোজেন ক্লোরাইড গ্যাস থেকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করছে অর্থাৎ অ্যামোনিয়া গ্যাসের ব্যাপন হার হাইড্রোজেন ক্লোরাইড গ্যাসের ব্যাপন হারের চেয়ে বেশি। এর কারণ মূলত এদের আণবিক ভর। যে গ্যাসের আণবিক ভর যত কম তার ব্যাপন হার তত বেশি। এখানে অ্যামোনিয়া গ্যাসের আণবিক ভর হাইড্রোজেন ক্লোরাইড গ্যাসের আণবিক ভরের চেয়ে কম। তাই NH, গ্যাস HCl গ্যাসের চেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করেছে। (NH, গ্যাসের আণবিক ভর 17 এবং HCl গ্যাসের আণবিক ভর 36.5) H, He, N2, O2 এবং CO2 গ্যাসগুলোর আণবিক ভর যথাক্রমে 2, 4, 28, 32 এবং 44। এই গ্যাসগুলোর মধ্যে H2 এর আণবিক ভর কম। তাই H2 এর ব্যাপন হার বেশি হবে এবং CO2 এর আণবিক ভর বেশি, কাজেই CO2 এর ব্যাপন হার কম হবে। |
সরু ছিদ্রপথে উচ্চচাপের স্থান থেকে কোনো গ্যাস নিম্নচাপের স্থানের দিকে সজোরে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়াকে নিঃসরণ বলে। একটি বেলুনকে ফুঁ দিয়ে ফোলাও। এবারে বেলুনের গায়ে এক টুকরা স্কচটেপ লাগাও। এখন একটি আলপিন দিয়ে স্কচটেপের উপর দিয়ে বেলুনটিকে ছিদ্র করো। কী দেখলে? বেলুনের ভিতরের সমস্ত বাতাস ছিদ্রপথ দিয়ে সজোরে বেরিয়ে গিয়ে বেলুনটি চুপসে গেছে (স্কচটেপ না লাগিয়ে বেলুনটা ফুটো করার চেষ্টা করলে সেটি সশব্দে ফেটে যাবে)। বেলুনের ভেতরে বাতাসের চাপ বেশি ছিল এবং বেলুনের বাইরে বাতাসের চাপ কম ছিল। তাই উচ্চচাপের প্রভাবে ছিদ্রপথ পাওয়ার সাথে সাথে বেলুনের বাতাস নিম্নচাপের স্থানের দিকে ধাবিত হয়েছে। এটি মূলত নিঃসরণ। অর্থাৎ সরু ছিদ্রপথে কোনো গ্যাসের অণুসমূহের উচ্চ চাপের স্থান থেকে নিম্নচাপের স্থানের দিকে সজোরে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়াকে নিঃসরণ বলে। তাপ প্রদান করলে ব্যাপনের মতো নিঃসরণের হারও বৃদ্ধি পায়।
আমরা যানবাহনে জ্বালানি হিসেবে সিএনজি (CNG: Compressed Natural Gas) ব্যবহার করি। এটি মূলত উচ্চচাপে সংকুচিত মিথেন গ্যাস। যানবাহন চালানোর সময় এটি সিলিন্ডার থেকে সজোরে বেরিয়ে এসে ইঞ্জিনে প্রবেশ করে। অর্থাৎ এখানে নিঃসরণের ঘটনা ঘটে। আবার, বাসাবাড়িতে জ্বালানি হিসেবে সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে মূলত প্রোপেন ও বিউটেন গ্যাসকে উচ্চচাপে সংকুচিত করে তরল অবস্থায় সিলিন্ডারে ভর্তি করা হয়। চুলা জ্বালানোর সময় যখন সিলিন্ডারের মুখ খুলে দেওয়া হয় তখন এটি গ্যাসে পরিণত হয়ে সজোরে বেরিয়ে আসে। অর্থাৎ এতেও নিঃসরণের ঘটনা পরিলক্ষিত হয় ।
ব্যাপন ও নিঃসরণ মূলত একই ঘটনা। এদের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো: ব্যাপনের ক্ষেত্রে চাপের প্রভাব নেই কিন্তু নিঃসরণের ক্ষেত্রে চাপের প্রভাব আছে। ব্যাপনের ক্ষেত্রে কোনো কঠিন, তরল বা গ্যাসীয় পদার্থ উপযুক্ত মাধ্যমে সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে কিন্তু নিঃসরণের ক্ষেত্রে কেবল গ্যাসীয় পদার্থ গ্যাসীয় মাধ্যমে সরু ছিদ্রপথ দিয়ে সজোরে পাত্র থেকে বের হয়ে আসে। রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে আমরা সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করি। আমরা যদি শুধু সিলিন্ডারের মুখ খুলে দেই এবং আগুন না ধরাই তবে সিলিন্ডার থেকে প্রথমে সরু ছিদ্রপথ দিয়ে গ্যাস বের হয়ে আসবে অর্থাৎ এক্ষেত্রে নিঃসরণের ঘটনা ঘটে। এরপর সিলিন্ডার থেকে বেরিয়ে আসা ঐ গ্যাস ঘরের চারদিকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে ব্যাপনের ঘটনা ঘটবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে প্রথমে নিঃসরণ তারপরে ব্যাপনের ঘটনা ঘটবে।
মোম হলো বিভিন্ন হাইড্রোকার্বনের মিশ্রণ। হাইড্রোজেন এবং কার্বন মিলে গঠিত জৈব যৌগই হলো হাইড্রোকার্বন। মোমের জ্বলনে আমরা মোমের কঠিন, তরল এবং গ্যাসীয় এই তিনটি অবস্থাই দেখতে পাই। মোমের মধ্যে একটি সুতা থাকে। এ সুতাতে আগুন জ্বালালে সুতার চারদিকে হাইড্রোকার্বন অণুগুলো তাপে গলে তরলে পরিণত হয়।
ঐ তরল মোম আগুনের তাপে প্রথমে বাষ্পে পরিণত হয়। অতএব ঐ বাষ্পীয় মোম বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বন ডাই-অক্সাইড, জলীয় বাষ্প, আলো এবং তাপ উৎপন্ন করে। তরল মোমের কিছু অংশ ঠাণ্ডা হলে কঠিন মোমে পরিণত হয়। অর্থাৎ তাপের প্রভাবে মোমের কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় এই তিন অবস্থারই অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
তাপ প্রয়োগে কোনো পদার্থের কঠিন অবস্থা থেকে তরল অবস্থায় রূপান্তর করার প্রক্রিয়াকে গলন বলে। 1 বায়ুমণ্ডলীয় চাপে তাপ প্রদানের ফলে যে তাপমাত্রায় কোনো কঠিন পদার্থ তরলে পরিণত হয় সেই তাপমাত্রাকে উত্ত কঠিন পদার্থের গলনাঙ্ক বলে। প্রত্যেক বিশুদ্ধ কঠিন পদার্থের একটি নির্দিষ্ট গলনাঙ্ক থাকে। যেমন— 1 বায়ুমণ্ডলীয় চাপে বরফের গলনাঙ্ক 0°CI
তাপ প্রয়োগ করে তরলকে গ্যাসে রূপান্তর করার প্রক্রিয়াকে স্ফুটন বলে। 1 বায়ুমণ্ডলীয় চাপে তাপ প্রদানের ফলে যে তাপমাত্রায় কোনো তরল পদার্থ গ্যাসীয় পদার্থে পরিণত হয় সেই তাপমাত্রাকে উত্ত তরল পদার্থের স্ফুটনাঙ্ক বলে। প্রত্যেক বিশুদ্ধ তরলের একটি নির্দিষ্ট স্ফুটনাঙ্ক থাকে। যেমন- 1 বায়ুমন্ডলীয় চাপে পানির স্ফুটনাঙ্ক 100°C। স্ফুটনের বিপরীত প্রক্রিয়াটির নাম ঘনীভবন। স্ফুটনের জন্যে তাপ দিতে হয়, ঘনীভবনের সময় তাপ সরিয়ে নিতে হয়।
পরীক্ষা নং: 4 আবার ধরা যাক, আমরা একটি অবিশুদ্ধ পদার্থ মোমের গলনাঙ্ক বের করতে চাই। মোম কিছু পদার্থের মিশ্রণ। মোমের গলনাঙ্ক নির্ণয় করতে হলে প্রথমে মোমকে চূর্ণ করে পাউডার বা গুঁড়ার পরিণত করতে হবে। এরপর মোমের পুড়াকে একটি এক মুখ বন্ধ কাচনলে নিয়ে ছবির মতো করে সেখানে একটি থার্মোমিটার রাখতে হবে। এবারে কাচনলটি বিকারের পানিতে এমনভাবে ডুৰাতে হবে যেন কাচনলের খোলা মুখে পানি প্রবেশ করতে না পারে। এখন বিকারটিতে ধীরে ধীরে তাপ প্রদান করতে হবে। এক পর্যায়ে দেখা যাবে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় মোম না পলে তাপমাত্রার একটি পরিসরে (range) মোম গলতে থাকে এবং তাপমাত্রার এই পরিসরই হলো মোমের গলনাঙ্ক । অবিশুদ্ধ পদার্থের গলনাঙ্ক বিশুদ্ধ পদার্থ থেকে কম হয়। স্ফুটনাঙ্ক বিশুদ্ধ থেকে বেশি হয়। মিশ্র পদার্থের সুনির্দিষ্ট গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক থাকে না। যেহেতু প্রত্যেক বিশুদ্ধ কঠিন পদার্থের একটি নির্দিষ্ট গলনাঙ্ক থাকে সেহেতু কঠিন পদার্থ একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় গলে থাকে। যদি দেখা যায় কোনো কঠিন পদার্থ তার গলনাঙ্ক ছাড়া অন্য কোনো তাপমাত্রায় গলছে সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে কঠিন পদার্থটি বিশুদ্ধ নয়। আবার যদি দেখা যায় কঠিন পদার্থটি একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার পরিসরে গলতে থাকে তাহলেও কঠিন পদার্থটি বিশুদ্ধ নয়। যেমন- 1 বায়ুমণ্ডলীয় চাপে বিশুদ্ধ সালফারের গলনাঙ্ক 115°C। কিন্তু কোনো একটি সালফার নমুনার গলনাঙ্ক নির্ণয় করার সময় যদি দেখা যায় ঐ সালফার নমুনা 115°C অপেক্ষা কম তাপমাত্রায় গলছে, তবে বুঝতে হবে ঐ নমুনা সালফার বিশুদ্ধ নয় এটি ভেজাল যুক্ত সালফার। গলনাঙ্ক নির্ণয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোনো কঠিন পদার্থ বিশুদ্ধ নাকি অবিশুদ্ধ তা নির্ণয় করা যায়। |
পরীক্ষা ন: 5 যে তরল পদার্থের স্ফুটনাঙ্ক নির্ণয় করতে হবে ঐ তরল পদার্থ (যেমন— পানি) এর কিছু পরিমাণ একটি বিকারে নেওয়া হয়। এই বিকারের মধ্যে 1টি থার্মোমিটার যুক্ত করা হয়। এখন সতর্কতার সাথে বুনসেন বার্নার দিয়ে বিকারটিকে উত্তপ্ত করা হয়। এক পর্যায়ে সমস্ত পানি একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বাষ্পে পরিণত হতে শুরু করবে। এই তাপমাত্রাই পানির স্ফুটনাঙ্ক । যেমন- পানিকে বিকারে নিয়ে উত্তপ্ত করলে 100°C তাপমাত্রায় সমস্ত পানি বাষ্পে পরিণত হয়। অর্থাৎ পানির স্ফুটনাঙ্ক 100°C (1 atrn চাপে)। যেহেতু প্রত্যেক বিশুদ্ধ ভরলের স্ফুটনাঙ্ক নির্দিষ্ট সেহেতু একাধিক ভরলের একই স্ফুটনাঙ্ক হতে পারে না। আবার, কোনো ভরলে ভেজাল মিশ্রিত থাকলে সেটি তার স্ফুটনাঙ্ক ব্যতীত ভিন্ন তাপমাত্রায় ফুটতে থাকে। যেমন-পানিতে সামান্য পরিমাণ অ্যালকোহল যোগ করলে 100°C তাপমাত্রা না হয়ে অন্য কোনো তাপমাত্রায় এটি ফুটবে। স্ফুটনাঙ্কের মাধ্যমে কোনো তরল পদার্থ বিশুদ্ধ নাকি অবিশুদ্ধ তা নির্ণয় করা যায়। |
তোমরা জানতে পেরেছো যে, পলন এবং স্ফুটনের সমর তাপ দেওয়া হলেও তাপমাত্রার পরিবর্তন হয় না। এই সময় যে তাপ দেওয়া হয় সেই ভাপটুকু পদার্থের অবস্থার পরিবর্তন করে অর্থাৎ কঠিন থেকে তরল কিংবা তরল থেকে গ্যাসে পরিবর্তন করে। আমরা যদি কোনো একটি কঠিন পদার্থকে তাপ দিয়ে প্রথমে তরল পরে তরলকে বাষ্পে পরিণত করি তাহলে আমরা কী দেখব? নিচের পরীক্ষাটি দেখে আমরা সেটি বুঝতে পারি।
পরীক্ষা নং: 6
চিত্র 2.09: বরকে তাপ প্রদানের লেখচিত্র। তাপ দেওয়ার সাথে সাথে কঠিন অবস্থার বরফের তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে যখন OC তাপমাত্রায় পৌঁছায়, তখন কঠিন বরফ গলনের মাধ্যমে তরল পানিতে পরিণত হয়। কঠিন পদার্থ বরফের গলনের পুরো সময় তাপমাত্রা 0°C তাপমাত্রায় থাকে। এই 0°C তাপমাত্রায়ই সমস্ত বরফ পানিতে পরিণত হয়। অর্থাৎ °C তাপমাত্রা বরফের গলনাঙ্ক। গলনাঙ্কের তাপমাত্রায় যে সরলরেখা পাওয়া যায় তাকে গলনাঙ্ক রেখা বলা হয়। এখানে AB রেখা বরফের গলনাঙ্ক রেখা। এই রেখা বরাবর বরফ ও পানি উভয়ই অবস্থান করে। এরপরও তাপ দিতে থাকলে তরল পানির তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। পানির তাপমাত্রা যখন 100°C এ পৌঁছে তখন পানিতে তাপ প্রদান করলেও তরল পানির তাপমাত্রা আর বাড়ে না, পানি জলীয় বাষ্পে পরিণত হতে থাকে। স্ফুটনের সময় তরল পানি জলীয় বাষ্পে পরিণত হয়। এই 100°C তাপমাত্রায়ই সমস্ত পানি প্যাসীর পানি অর্থাৎ জলীয় বাষ্পে পরিণত হয়। এরপরও তাপমাত্রা বাড়াতে থাকলে জলীয় বাষ্পের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। পানির স্ফুটনাঙ্ক 100°C। CD রেখা পানির স্ফুটনাঙ্ক রেখা। এই রেখা বরাবর সময়ে পানি এবং জলীয়বাষ্প উভয়ই এক সাথে অবস্থান করে।
আবার, পানির বাষ্পকে নিয়ে শীতল করে প্রাপ্ত ডাটাগুলোকে একটি গ্রাফ পেপারের X অক্ষে সমর এবং Y অক্ষে তাপমাত্রা নিয়ে লেখচিত্র অঙ্কন করলে নিম্নরূপ রেখা পাওয়া যাবে :
চিত্র 2.10: জলীয় বাষ্পকে শীতলকরণের লেখচিত্র। লেখচিত্র থেকে দেখা যার, শুরুতে জলীয় বাষ্পের তাপমাত্রা 140°C। এই জলীয় বাষ্পকে শীতল বা ঠাণ্ডা করে যখন তাপমাত্রা 140°C থেকে কমিয়ে 100°C এ নিয়ে যাওয়া হয় তখন জলীয় বাষ্প পানিতে পরিণত হতে শুরু করে। যতক্ষণ জলীয় বাষ্প পানিতে পরিণত হতে থাকে ততক্ষণ পানির তাপমাত্রা 100°C থাকে। এরপরও পানিকে ঠান্ডা করতে থাকলে পানির তাপমাত্রা কমতে থাকে। ঠাণ্ডা করতে করতে যখন পানির তাপমাত্রা 0°C তাপমাত্রায় পৌঁছে তখন তরল পানি কঠিন বরফে পরিণত হতে শুরু করে। এর পরেও পানিকে ঠাণ্ডা করলে পানির তাপমাত্রা আর কমে না। যখন সমস্ত তরল পানি কঠিন বরফে পরিণত হয় তখন বরফের তাপমাত্রা 0°C থেকে কমতে থাকে। চিত্রে - 40°C তাপমাত্রা পর্যন্ত বরফের তাপমাত্রা কমানো দেখানো হয়েছে। |
কোনো তরলকে তাপ প্রদান করে ঐ তরল পদার্থকে বাষ্পে পরিণত করার প্রক্রিয়াকে বাষ্পীভবন বলে। যেমন— চায়ের কাপে গরম চা রাখলে ঐ গরম চা থেকে পানি বাষ্পাকারে উড়ে যায়। এটি বাষ্পীভবনের উদাহরণ। আবার, তর বাপকে শীতল করলে তা তরলে পরিণত হয় যাকে ঘনীভবন বলে। যেমন- জলীয় বাষ্প তাপশক্তি নির্গত করে ঠাণ্ডা হয়ে পানিতে পরিণত হয়। এটি ঘনীভবন প্রক্রিয়ার উদাহরণ। কোনো তরলকে তাগ প্রদানে বাষ্পে পরিণত করে তাকে পুনরায় শীতলীকরণের মাধ্যমে তরলে পরিণত করার পদ্ধতিকে পাতন বলে। অর্থাৎ
পাতন = বাষ্পীভবন + ঘনীভবন (Distillation= Vaporization + Condensation) |
যে প্রক্রিয়ার কোনো কঠিন পদার্থকে তাপ প্রদান করা হলে সেগুলো তরলে পরিণত না হয়ে সরাসরি বাষ্পে পরিণত হয়, সেই প্রক্রিয়াকে ঊর্ধ্বপাতন বলে। নিশাদল (NH, Cl), কর্পূর (C10H160), ন্যাপথলিন (CoHg), কঠিন কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2), আয়োডিন (I2), অ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড (AlCl) এই পদার্থগুলোকে ভাগ প্রদান করা হলে সেগুলো তরলে পরিণত না হয়ে সরাসরি বাষ্পে পরিণত হয়। এই পদার্থগুলোকে ঊর্ধ্বপাতিত পদার্থ বলা হয়। যেমন-কঠিন ন্যাপথলিনকে তাপ দিলে সেটি তরল না হয়ে সরাসরি গ্যাসীয় পদার্থে পরিণত হয়।
পরীক্ষা নং: 07
চিত্র 2.11: উদ্বায়ী পদার্থের ঊর্ধ্বপাতন।
আবার, কঠিন অবস্থায় ঊর্ধ্বপাতিত পদার্থে তাপ প্রয়োগ করতে থাকলে ঊর্ধ্বপাতিত পদার্থ সহজেই বাষ্পীভূত হয়। আয়োডিন মিশ্রিত খাদ্য লবণের মধ্যে আয়োডিন একটি ঊর্ধ্বপাতিত পদার্থ। কাজেই ঐ আয়োডিন মিশ্রিত খাদ্য লবণের মিশ্রণকে তাপ দিলে আয়োডিন সহজেই বাষ্পীভূত হয়। ঐ বাষ্পকে ঠাণ্ডা করে কঠিন আয়োডিনে পরিণত করা যায়। আবার, বালি এবং গ্লুকোজের মিশ্রণের মধ্যে কোনো ঊর্ধ্বপাতিত পদার্থ নেই। কাজেই তাপ প্ররোপ করে বালি এবং গ্লুকোজের মিশ্রণ থেকে বালি এবং গ্লুকোজকে আলাদা করা যায় না।
চিত্র 2.12: AlCl3 এর ঊর্ধ্বপাতন। |
আরও দেখুন...